- দাদা ও চাচার কাছে মহানবী (সা.)-এর বেড়ে উঠা। যেখানে এক শিশুর জীবনে শোকের গভীরতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভালবাসার অফুরন্ত ঝর্ণাধারা। সেই ভালোবাসা তাঁকে গড়েছে, প্রস্তুত করেছে, একদিন গোটা মানবতার মুক্তিদূত হওয়ার জন্য।
পিতার কোমল হাতের পরশ পাবার আগেই যে শিশু পিতৃহীন হয়ে পড়ে, তার জীবনে প্রথম শূন্যতার পাঠ হয় নীরব কান্নায়। সেই শিশুটি ছিলেন মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর জন্মের আগেই ইন্তেকাল করেন পিতা আবদুল্লাহ। মাতার আঁচলে নিজেকে জড়িয়ে বড় হয়ে ওঠা শিশুটির জীবনে তখন একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠেন তাঁর স্নেহময়ী মা আমিনাহ। কিন্তু সেই আশ্রয়টুকুও বেশি দিন সঙ্গ দেয়নি।ছেলে মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে সাইয়্যেদাহ আমিনাহ যখন স্বামী আবদুল্লাহর কবর জিয়ারতের অভিপ্রায়ে মদিনায় গিয়েছিলেন। তখন তিনি বুঝতেই পারেননি যে, এ সফরই হবে তাঁর জীবনের শেষ যাত্রা। ফিরে আসার পথেই আবুয়া নামক এক পহাড়ি উপত্যকায় নিঃশব্দে থেমে যায় তাঁর নিঃশ্বাস। ছেলের শোক-জর্জর হৃদয়ে নেমে আসে পাহাড়সম ভার । ছায়া হারানো সেই চোখ দুটো আর খুঁজে পায় না পৃথিবীর স্বস্তির রঙ।বৃদ্ধ দাদা আবদুল মুত্তালিব এ সংবাদ পেয়ে ভেঙে পড়েন। যিনি মাত্র কয়েক বছর আগে পুত্র আবদুল্লাহর মৃত্যুতেই ছিলেন ব্যথিত আর শোকাহত। এবার পুত্রবধূ আমিনাহর মৃত্যু তাঁকে আরও গভীরভাবে নাড়া দেয়। কারণ, আমিনাহ শুধু তাঁর মৃত পুত্রের স্মৃতিবাহী ছিলেন না; বরং তিনিই ছিলেন শিশু মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। সেই অবলম্বনও না থাকায়, শিশুটির সমস্ত নিঃসঙ্গতা যেন তাঁর বৃদ্ধ হৃদয়েও ঝড় তুলে।যার দরুন তিনি এগিয়ে এলেন আশ্রয় হয়ে, শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাথায় রাখলেন সান্ত্বনার হাত। মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে যেন জীবনের সমস্ত স্নেহ আর ভালোবাসা ঢেলে দিলেন তাঁর মধ্যে। কখনো মনে হতো, এই সন্তান তাঁর নিজের ঔরসজাত ছেলের চেয়েও বেশি প্রিয়।কাবা ঘরের পাশে এক বিশেষ আসন ছিল। যা কেবল আবদুল মুত্তালিবের জন্যই নির্দিষ্ট। কেউ সেখানে বসার সাহস করতো না। একমাত্র মুহাম্মাদ (সা.) সে নিয়ম ভেঙে শিশুসুলভভাবে সোজা চলে যেতেন দাদার পাশে। আপন ভঙ্গিমায় বসতেন সেই আসনে। চাচারা মাঝে মাঝে তাঁকে টেনে সরিয়ে দিতে চাইতেন, কিন্তু দাদা থামিয়ে দিতেন, বলতেন, “ওকে বিরক্ত কোরো না। আল্লাহর কসম, এই শিশু সাধারণ কোনো শিশু নয়। সে এক অনন্য শিশু, মনে হচ্ছে সে মহান এক উদ্দেশ্যের বাহক।” দাদা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন, সন্তুষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। কিন্তু আট বছর দুই মাস দশ দিন বয়সে মুহাম্মাদ (সা.) যখন দাদা আবদুল মুত্তালিবকেও হারালেন, তখন তাঁর জীবনে যেন আরও এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। একে একে সব প্রিয় মুখ হারিয়ে শিশু হৃদয় বার বারে হোচট খাচ্ছিল। তখন চাচা আবু ত্বালিব আগ বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। পিতার অসিয়ত মেনে ভ্রাতুষ্পুত্রকে তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।
আবু ত্বালিব শুধু তাঁকে আশ্রয়ই দিলেন না, বরং নিজের সন্তানদের চেয়েও বেশি ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখলেন ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে। তাঁর চলাফেরা, কথা, ভাবভঙ্গি; সব কিছুতেই গভীর মনোযোগ রাখতেন। ছোট্ট মুহাম্মাদ (সা.)-এর গাম্ভীর্য, শিষ্টতা আর স্নিগ্ধতা তাঁর অন্তর জয় করে নিয়েছিল।
বারো বছর বয়সে মুহাম্মাদ (সা.)-কে সঙ্গে নিয়ে আবু ত্বালিব একবার সিরিয়ার (শাম) উদ্দেশ্যে ব্যবসায়িক সফরে রওনা হন। কাফেলা পৌঁছায় বসরা শহরে। যা রোমান সাম্রাজ্যের অধীন একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। আর সেখানে এক খ্রিস্টান সাধু বসবাস করতেন, নাম বাহীরা। তিনি ছিলেন একধরনের দীক্ষিত সাধক, যিনি বাইবেল পাঠ করে ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতীক্ষায় থাকতেন।সেদিনের কাফেলা দেখে আচমকা বাহীরা নিজের গীর্জা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তিনি সরাসরি মুহাম্মাদ (সা.)-এর দিকে এগিয়ে যান। দেখলেন তাঁর চোখে আকাশের বিশালতা, চেহারায় প্রজ্ঞার দীপ্তি। এরপর মুখ টিপে হেসে বললেন, “এই কিশোরই সেই চূড়ান্ত রাসুল, যার প্রতীক্ষায় যুগ যুগ ধরে আমি প্রহর গুনছি। তিনিই হবেন বিশ্বের করুণা, মানবজাতির জন্য আলোর পথিক।”
চমকে উঠলেন চাচা আবু ত্বালিব ও সঙ্গীরা। বাহীরা ব্যাখ্যা দিলেন, “আমি দেখেছি, পাহাড়ের পথ ধরে আসার সময় এ কিশোরের প্রতি সব গাছ-পাথর সিজদা করছে। আর এরা নবী ছাড়া অন্য কাউকে কখনো সিজদা করে না। তাঁর কাঁধের পাশে রয়েছে ‘মোহরে নবুওয়ত’। যা আমাদের ধর্মগ্রন্থেই বর্ণিত হয়েছে।”
এরপর গভীর উদ্বেগে তিনি চাচাকে সতর্ক করে বললেন, “তাঁকে নিয়ে ফিরে যান মক্কায়। ইহুদী বা রোমানরা যদি বুঝতে পারে, কে এই কিশোর, তবে হয়তো তাঁকে হত্যা করতে পিছপা হবে না।”
এই সতর্কতায় চাচা আবু ত্বালিব দেরি করলেন না। মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে মক্কার পথে ফিরে গেলেন। কিছু গোলামকে তাঁর সঙ্গে পাঠিয়ে নিশ্চিত করলেন নিরাপদ প্রত্যাবর্তন।
এই ছিল আখেরি নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সেই পবিত্র শৈশবের ছায়াচিত্র। যেখানে এক শিশুর জীবনে শোকের গভীরতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভালবাসার অফুরন্ত ঝর্ণাধারা। সেই ভালোবাসা তাঁকে গড়েছে, প্রস্তুত করেছে, একদিন গোটা মানবতার মুক্তিদূত হওয়ার জন্য।
(আর রাহীকুল মাখতুম অবলম্বনে)
-[চলবে… ইনশাআল্লাহ]